উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান হবার সুবাদে কিংবা সচেতন পিতা-মাতার সন্তান হবার সুবাদে কখনো কুসংস্কারাচ্ছন্নতা,অসেচতনতা,অবহেলা আমাকে স্পর্শ করেনি।জীবন সম্পর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে কখনো অন্ধকারে থাকতে হয়নি আমাকে।যথাযথ সময়ে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অবগত করা এবং সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়াকে কর্তব্য বলে মনে করেন আমার গুরুজনেরা।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমি রজঃস্বলা হই চৌদ্দ/পনেরো বছর বয়সে।পাঠ্যবইয়ের বদৌলতে পিরিয়ড নিয়ে খানিকটা ধারণা ছিলো আমার সে বয়সে।সেদিন প্রথম যখন জীবনের এই জটিল অথচ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হলাম সেদিন আমার অধ্যাপিকা মা তাঁর কাছে টেনে নিয়ে আমাকে জীবনদর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা দিলেন।মায়ের বলা সেদিনের কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে।কথোপকথনটুকু ছিলো এরকম – “
“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী—
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন ।
সঁপিয়া তোমার ’পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা । ”
এই সমাজ-সংসারে নারীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ‘মানসী’ গ্রন্থে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উক্ত উক্তিটির রচনা করেন। নারীজন্ম একই সাথে ভীষণ গর্বের, আনন্দের এবং অহংকারের। নারীর হাত ধরেই বিশ্বসংসারের বিস্তৃতি ঘটেছে।বিধাতা নারীদের নবপ্রাণ জন্ম দেবার দ্বায়িত্ব কিংবা ক্ষমতা দিয়েছেন।এত বড় দ্বায়িত্ব পালন করা তো খুব একটা সহজ নয়,এর জন্যে কিছুটা কষ্ট করতে হয়।তোমার কষ্টের দিন আজ থেকে শুরু হলো। তবুও সেই কষ্টের পেছনে রয়েছে এক মহৎ কারণ।সময়ের সাথে সাথে তুমি সব বুঝতে পারবে।আজ যতটুকু বলার আমি তোমাকে বলবো।সমাজের মূলস্রোতের অন্যতম কাণ্ডারী ‘নারী’ দের যাপিত জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘ঋতুস্রাব বা রজঃস্রাব’। সাধারণত এর ইংরেজি ‘পিরিয়ড’ শব্দটি সমধিক পরিচিত।ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড হলো উচ্চতর প্রাইমেট বর্গের স্তন্যপায়ী স্তরী- একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা প্রজননের সঙ্গে সম্পর্কিত।এটি নারীজীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।একজন নারীর ঋতুস্রাব শুরু হয় বয়ঃসন্ধিকালে (মেনার্চি-তে) এবং স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় রজোনিবৃত্তির (মেনোপজের) সাথে।
পিরিয়ডকে নারীর ‘গর্ভধারণের প্রাথমিক লক্ষণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আমি জানি,তুমি ভীষণ সাহসী এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। জীবনের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক-সাবলীল জীবন যাপন করবে এবং মনে রাখবে এটি তোমার দূর্বলতা নয় বরং শক্তি-সক্ষমতা। “
সেদিন থেকে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, পিরিয়ড আমার দূর্বলতা নয় বরং ভীষণ গর্বের বিষয়।এটি আমারসহ পৃথিবীর সকল নারীর আত্মপরিচয়ের প্রতীক।আমি ভীষণ ভাগ্যবান যে এমন একজন মা পেয়েছি। যিনি আমাকে সঠিক জীবনবোধের ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে হেয় করে দেখেন এমনকি অসংখ্য নারী মা এই সমস্যাটি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নন।তারা এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটির নাম দিয়েছেন ‘অসুস্থতা’। আজও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অগণিত নারী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে – ” আমি অসুস্থ ছিলাম তাই গত পাঁচ/সাতদিন আসতে পারিনি!” সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,উপযুক্ত স্যানিটারি প্রোডাক্টের অভাবে এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়েসের মেয়েরা গড়ে মাসে ৫ দিন, মানে বছরে পঞ্চাশ দিনের মত বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।আধুনিক সভ্যসমাজে এ ধরনের সংস্কারাচ্ছন্নতা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক।এমনকি,কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ৫%।২০১৮ সালের ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে,একবিংশ শতাব্দীতে অবস্থান করেও বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ কিশোরী এবং ৬৪.৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী পিরিয়ডের সময় পুরাতন কাপড় ব্যবহার করেন। এদিকে, ২০১৪ সালের ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী পিরিয়ডের সময় পুরাতন কাপড় ব্যবহার করতেন এবং তখন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতেন মাত্র ১৪ শতাংশ নারী। তবে ২০১৮ সালের ঐ সার্ভে অনুযায়ী, বর্তমানে শতকরা ৪৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন।আরো জানা যায় যে,বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীরা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে দোকানে যেতেও সংকোচ বোধ করেন এবং যান না।ক্রয়ের কাজটি অবিবাহিত নারীদের পিতা এবং বিবাহিত নারীদের স্বামীদের করতে হয়।বহুবছর ধরে পিরিয়ডের প্রতি অবহেলা,অসচেতনতা,স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রতি গুরুত্বহীনতার এই সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে এক ধরনের গোঁড়ামি।এই ধরনের সংস্কার এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার পর দোকানির করা কয়েক স্তরের মোড়ক,গোপনীয়তা,এক ধরনের লুকোচুরি খেলার মতো প্রবণতা নারীদের এবং পিরিয়ড কিংবা ঋতুস্রাবের মতো স্বাভাবিক-চিরন্তন জীবনপ্রক্রিয়ার মর্যাদাহানি করেছে।সেইসঙ্গে,সমাজের চোখে একে একটি নিষিদ্ধ প্রক্রিয়া আর হাসির খোরাকে পরিণত করেছে।এ কারণেই,তরুণ পুরুষেরা হয়ে ওঠেছে এর প্রতি অধিক আকৃষ্ট।ফলশ্রুতিতে, প্রতিনিয়ত নারীদের নানা ধরনের সামাজিক সহিংসতা এবং হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে,বিশ্বের প্রতিটি রজঃস্বলা নারীকে মাসে ৫ দিন করে হলেও গোটা জীবনে গড়ে ৭ বছর সময়কাল ঋতুস্রাব নিয়ে কাটাতে হয়। পিরিয়ডকালীন সময়ে নারীদের উচিত সুষম খাদ্য গ্রহণ,স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা এবং যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবন যাপন করা।কখনোই, ভয়-লজ্জায় কু্ঁকড়ে বিদ্যালয়-কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকা কাম্য নয়।বাঁচতে হলে এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে,জানতে হবে।পিরিয়ড নিয়ে সমাজের সকল কুসংস্কারাচ্ছনতা দূর হোক।সকল গোপনীয়তার বাঁধ ভাঙুক। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে পিরিয়ডের কারণে নারীর মাতৃত্বকে মহান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেই পিরিয়ডকালীন সময়ে নারীকে অচ্ছ্যুৎ তথা অপরিষ্কার বলে আখ্যায়িত করার মতো সামাজিক রীতির পরিবর্তন ঘটানো ভীষণ প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উচিত পিরিয়ডকে কোনো ট্যাবু করে না রেখে সর্বস্তরে এর সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো এবং পিরিয়ডের পণ্যগুলিকে পিংক ট্যাক্সের বেড়াজাল থেকে অবমুক্ত করে সকলের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত পিরিয়ডের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া জননী-জায়া-ভগ্নি-প্রেমিকাসহ সকল নারীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং স্ব স্ব পরিবারকে নারীর পিরিয়ডবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা।আর অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে-
“নারী-ই বিজয়িনী।আমি নারী, আমি সব পারি!”
লেখক : শানিন হক, শিক্ষার্থী