পিরিয়ডে চাই নারী-পুরুষের সচেতনতা, সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা

সমস্যা যেখানে সকলের স্কন্ধে ভূতের মতো ঝুলে আছে সেখানে, সেই দেশে পিরিয়ড কিংবা মাসিক নিয়ে একটা দুটো কথাও কতিপয় জনগণের কাছে চরম বিরক্তির কারণ হতে পারে। কিন্তু আমরা নারীরা কি-ই-বা করতে পারি। কথা বলি আর নাইবা বলি অবধারিতভাবে এই মাসিকের রীতি বহন তো আমাদের করতেই হবে।

‘পিরিয়ড’-যে শব্দটি সব মেয়ের কাছে সাধারণের চেয়েও সাধারণ, নিত্য নৈমিত্তিক ঘটার মতো বিষয়, সেই পিরিয়ডকে ক’টা মানুষ সাধারণভাবে,সাধারণ চোখে দেখে এই প্রশ্নের উত্তর বোধকরি কারো কাছেই নেই।মুখে বড় বড় বুলি যতোই আউড়ে যাই না কেনো,যতোই মহাকাশ জয় করিনা কেনো,যতোই তথ্য প্রযুক্তিতে তাক লাগিয়ে দেইনা কেনো আমরা কোনোভাবেই পিরিয়ডকে জয় করতে পারিনি। আমাদের মানসিক উদারতা কিংবা সামাজিক দায়বদ্ধতা কোনোটিই পিরিয়ডকে ঘিরে পালন করা হয়না কিংবা প্রকাশ করা হয়না।তাই পিরিয়ড এখনো ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখার মতো বিষয় ই রয়ে গেছে। যেন পিরিয়ড এক অভিশাপ, যে অভিশাপে তছনছ হচ্ছে সমাজ,লোকলজ্জা সব! অথচ বাস্তবে পিরিয়ডের আশীর্বাদ ছাড়া নারী কখনো মা হতেই পারেনা।যেই মা কে সবাই অন্য আসনে বসায়,সেই মায়ের ভিতরে থাকা নারীসত্ত্বা যে পিরিয়ডের -ই ফসল,ক’জন ই বা তা মানে!

এই উন্নত বিশ্বের শত শত রোশনা,চাকচিক্যের আড়ালে ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া নারীর আর্তনাদ বুঝি কানে শোনা যায়না! এ আর্তনাদ বুঝি শুধুই নিজের! কিন্তু কেনো?! কেনো এ অদ্ভুত নিয়ম? কেনো এ অদ্ভুত সমাজ ব্যবস্থা? কেনো এ অদ্ভুত মানসিকতা আমাদের সবার?!

কবি ফররুখ আহমদ এর ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে,”রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী? “

সমাজের এই রাত কবে শেষ হবে,কবে কোন ভোরে নারী তার ব্যথাটুকু অন্তত সবাইকে বলতে পারবে সেই উত্তর মেলা ভার!

পিরিয়ডকে লুকিয়ে রাখার চল নারী বহু যুগ আগে হতেই শিখে এসেছে। বাসায় মা বারণ করে দেন,”এসব কাউকে বলতে হয়না।” বড় বোন বারণ করে দেন,”এসব লজ্জার!কাউকে ভুলেও বলিস না যেন!” কিন্তু পিরিয়ড কি লজ্জার?আমি মনে করি পিরিয়ড নারীত্বের প্রতীক, মাতৃত্বের প্রতীক কিন্তু লজ্জার প্রতীক তো নয়। অথচ আমরা সে কথা কাউকে না পারছি বলতে,না পারছি বোঝাতে! দিনশেষে ব্যর্থতার তিলক পরে গুমরে মরতে হচ্ছে আমাদেরকেই।

পিরিয়ডের দিনগুলোয় শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি ‘মুড সুইং’এর বিষয়টি খুব আসে।অথচ এই বিষয়টি আজ ও অনেকের কাছেই নতুন। এই মুড সুইং এর কারণে অহেতুক রাগ কিংবা মন খারাপ হয়।এই তুচ্ছ বিষয়গুলোতে সাপোর্ট তো দূরের কথা, ভুল বোঝাবুঝি হয় কাছের মানুষগুলোর সাথেও।কিন্তু কেউ যাচাই করেনা আসল বিষয় কি! এই ঘটনার সাক্ষী হয়তো আমার মতো আরো অজস্র মেয়ে।

পিরিয়ড কোনো রোগ নয়,পিরিয়ড একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। কারো পিরিয়ড হলে,আশেপাশের মানুষগুলো এমন আচরণ করতে থাকে যেন বড় কোনো রোগ হয়েছে। না!আমি বলতে চাই প্লিজ এমন করবেন না।স্বাভাবিক সাধারণ বিষয় এটি। অনেকের তীব্র ব্যথা থাকায় তারা দৈনন্দিন কাজে কিছুটা বিরতি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা শারীরিক ক্ষমতা রাখে অন্য কাজ করার। তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না। পিরিয়ড নিয়েও সব কাজ করা যায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। টিপ্পনী কাটার কিছু নেই। আমরা নিজেরা যতোদিন পিরিয়ডকে সাধারণ বলে উপস্থাপন না করবো ততোদিন সমাজের এই ট্যাবু কোনোদিন যাবেনা।

অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময়কালে পার্থক্য দেয়া দেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কখনো কখনো দু মাস অতিক্রম হয়ে যায়। আর আসল দুঃখের বিষয় তখনই নজরে আসে। নিজের মা,তিনিও যেন তাঁর মেয়েটিকে বিশ্বাস করতে চান না। অসভ্য, অশালীন, অহেতুক ভাবনা উঁকি দেয় তাঁর মাথায়। হয়তো একসময় চিকিৎসক এর দ্বারস্থ হতে হয়। স্বভাবগতভাবে তিনিও প্রশ্ন করে বসেন বৈবাহিক অবস্থা নিয়ে।অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তখন পরতে হয় যখন একজন চিকিৎসক সব জেনেও অবিবাহিত এক নারীকে প্রেগন্যান্সির টেস্ট দিয়ে বসেন। এ ঘটনা যখন আমার কোনো পরিচিত কারো সাথে ঘটেছে তখন ই আমি তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। পিরিয়ড মিস অবশ্যই ভালো কথা নয়।সেজন্য আলট্রাসনোগ্রাম ই যথেষ্ট। তাই বলে একজন চিকিৎসক যখন অবিবাহিত নারীকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেন,তখন বাকিরাও প্রকাশ করতেই চান না যে তাদের পিরিয়ড মিস হচ্ছে। এ যেন এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রণা। কাউকে বলা যায়না। পক্ষান্তরে গোপন করার কারণে সবার অগোচরেই শরীরে বাসা বাঁধছে নানান জটিল রোগ। প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য নারী। এ দায়ভার আসলে কার? এই মানসিক যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা,অহেতুক সন্দেহের স্বীকার নারীরা বুক চাপড়ে কাঁদতে পর্যন্ত পারেনা।পিরিয়ডের এই বিষয়গুলো আদৌও পরিবর্তন হবে কি???

একটা মেয়ে যখন পিরিয়ড কি প্রথম বুঝতে পারে,তখন থেকে তার জীবনে পিরিয়ড শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নানান, অভিজ্ঞতা, কষ্ট, যন্ত্রণা তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। কেউ কেউ হয়তো গোপনেই তা ধারণ করেন।এই প্রযুক্তির যুগে কেউ কেউ চান তা আরো দশজনের কাছে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সেখানেও। একজন মেয়ে যখন পিরিয়ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে কিংবা কিছু লিখতেও চায়,তখন এক শ্রেণির সুশীল সমাজের কাছে তা ঘেন্নার বিষয় হয়ে ওঠে।গালাগালি কিংবা বাজে মন্তব্য করে নিজেদের পশু প্রবৃত্তির জানান দেয় তারা।অথচ তাদের ঘরেও আছে মা,বোন,স্ত্রী কিংবা কন্যা! এমন মানুষ আছে বলেই নারীরা পদে পদে নিরাপত্তা হীনতায় ভোগে। আবার অনেকে তো ভদ্রলোকের পোশাক ধারণ করলেও পিরিয়ড নিয়ে দু চারটা মুখরোচক কথা না বললে যেন তাদের চলেই না! হায়রে সমাজ,ভুলে যায় নারীগর্ভেই তার জন্ম! আর পিরিয়ড ছাড়া নারীত্ব আর কিসে!

পিরিয়ডের সময় তলপেটের চিনচিনে ব্যথার সাথে মাথায় ভর করা ভয় নারী একা ই সামলায়..ব্যথার বাহানায় কিছু করতে না পারলে পাছে তাকে না শুনতে হয়,”ঢং,ন্যাকামি! “কিন্তু পিরিয়ডের ব্যথা তো ঢং কিংবা ন্যাকামি নয়।এটি এক শ্বাশত বিষয়। কেনো আমরা মেয়েরা এসব কথার ভাগীদার হই তা আমরা নিজেও জানিনা।আমরা শুধু জানি আমরা তো মেয়ে! আমরা তো নারী! বোঝা আর বোঝানো,মানা আর মানানোতেই একটা পুরো জীবন আমাদের দিতে হয়,হয়তো হবেই!

পরিশেষে বলতে চাই,পিরিয়ড কোনো গোপন বিষয় নয়।পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতা নারী পুরুষ প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশকীয়। সচেতন না হলে পুরুষ আজ তার মা,কাল তার স্ত্রী, পরশু বোন,তারপর কন্যা সন্তানকেও হারাতে পারে।পক্ষান্তরে, নারী পুরুষের সচেতনতা, সহযোগিতা আর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ই পারে সমাজ থেকে পিরিয়ড কেন্দ্রিক জটিলতা কিংবা কুসংস্কার দূর করতে। আসুন পিরিয়ডকে অভিশাপ না ভেবে সবাই সচেতন হই।তাহলেই হয়তো আগামীদিনের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে।

লেখক : সিদরাতুল মানতাহা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়