পিরিয়ডে পরিবারই হোক প্রথম বন্ধু

একজন কিশোরীর কাছে বয়ঃসন্ধিতে সবচেয়ে কৌতুহলের শব্দ হচ্ছে ঋতুস্রাব, মাসিক বা পিরিয়ড। আরো অনেক শব্দই থাকতে পারে, তবে এ শব্দগুলো সম্পর্কে কৌতুহল থাকে অনেক। আমাদের দেশে ঋতুস্রাব শব্দটি মা চাচি দের কাছে ‘মাসিক’ বলেই বেশি পরিচিত। এই শব্দটির মাঝে লুকিয়ে আছে মেয়েদের সংকোচ, ভয়, লজ্জা ইত্যাদি। তবে প্রতিটি মায়ের কাছে তার মেয়ের প্রথম ঋতুস্রাব হওয়াটা তার কাছে আনন্দের এবং রোমাঞ্চকর। কেননা বয়ঃসন্ধিতে একটি মেয়ের ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার মাধ্যমে তার শরীরে পূর্ণতা আসে।এটা পৃথিবীর সকল মেয়েদের জন্য সার্বজনীন।

প্রাকৃতিক ভাবে মেয়েদের পরিণত বয়সে ঋতুস্রাব হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এই পরিপূর্ণতা পাওয়াটা খুব সহজ বা মসৃণ নয়।এর জন্য সহ্য করতে হয় অসম্ভব যন্ত্রণা, যাপন করতে হয় নিদ্রাহীন রাত,সমস্ত শরীর যেন পৃথিবীর ব্যথাদায়ক কষ্টের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে।প্রতিটি মেয়ের কাছেই তার প্রথম ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার দিনটি তার কাছে স্মরনীয়। এর মধ্যে জড়িয়ে থাকে অপ্রকাশিত একটি গল্প বা স্মৃতি। এ প্রসঙ্গে আমার খুব ভালো করে মনে পড়ে যায় ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর এর দিনটির কথা। আমার পূর্বে ধারনা ছিল মেয়েদের যখন বিয়ে হয় তখন ঋতুস্রাব শুরু হয়। কিন্তু আমার এই ধারনা ভুল প্রমানিত হয় এই দিনটিতে। ১ডিসেম্বর আমার ষষ্ঠ শ্রেনীর বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। সেদিন ছিল আমার ইংরেজি ১ম পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি আগে শেষ হলেও পরীক্ষার আগেরদিন একজন পরীক্ষার্থীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কিন্তু তার ঠিক আগের রাতে আমি এক অপ্রত্যাশিত যন্ত্রণার টের পাই।রাত ১০ টার পর থেকে পেটের নিচে অর্থাৎ তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করি। যেটা আমার কাছে খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। পড়াশোনাতে মনযোগ দিতে পারছিলাম না। খুব খারাপ লাগছিলো। পরীক্ষার ব্যপারে আমি খুব সিরিয়াস ছিলাম। কোনো পরীক্ষায় যদি সব প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারতাম তাহলে আমার মন খারাপের সীমা ছিল না। আর সে আমি আজ পড়াশোনা করতে পারছি না।খুব অস্বস্তি লাগছিল। রীতিমত রাত যত গভীর হচ্ছিলো ব্যথা তত তীব্র আকার ধারন করছিল। কোনো ক্রমেই ঘুমাতে পারছিলাম না।খুব আফসোস হতে লাগলে।মনে হচ্ছিল সবাই কতো পড়াশোনা করছে, আর আমি শুয়ে বসে সময় পার করতছি।আমি বিছানায় ব্যথায় ছটফট করছিলাম।কতক্ষণ শুয়ে থাকি,আবার বসে থাকি,কখনো হাটাহাটি করি।কিন্তু কোনো অবস্থানেই আরাম লাগছিলো না।সেদিন ঘুমও যেন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে পালিয়ে গিয়েছিল। ।কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না।একবার ভাবলাম আম্মুকে ডাক দেই,কিন্তু তা করতে পারলাম না।

ছোটকাল থেকেই আমি আমার সমস্যার কথা চাপা রাখতাম।সমস্যার কথা বললেই আম্মু ঔষধ খেতে দিবে।কিন্তু আমি ঔষধ খুব অপছন্দ করি।তাই আম্মু কে ডাক দিলাম না।আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি হয়তে মরে যাবো।মরার সময় কাউকে দেখবো না এই ভেবে কান্না করেছিলাম।এভাবে একটি দীর্ঘ যন্ত্রণাময় রাত কেটতে লাগল। এরইমধ্যে কয়েকবার টয়লেটে গিয়েছি এই ভেবে যে হয়তো টয়লেটে গেলে ভালো লাগবে।কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমানিত হলো।ব্যথা কিছুতেই কমছিল না।এরপর ফজরের আযান শুনতে পেলাম।যখন একটু একটু করে ভোরের আলো ছড়াতে লাগলো,আমি তখন ঘরের বাহিরে এলাম।পায়ের গোড়ালিতে রক্ত দেখলাম।

লজ্জা স্থানের নিচে সালোয়ারে দেখলাম অনেক রক্ত। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে কোথা থেকে রক্ত আসছে।সাথে সাথে আম্মুকে ডেকে সব বললাম।আম্মু খুব স্বাভাবিক ভাবে হেসে দিল।কোনো ভয়ের ছাপ নেই আম্মুর মুখে।আমি খুব আশ্চর্য ও বিরক্ত হয়ে বললাম,আমি ব্যথায় ছটফট করছি।আর তুমি হাসতাছো?আম্মু বলল ভয়ের কিছু নাই।এখন থেকে প্রতি মাসেই তোর এরকম হবে।এটাকে মাসিক বলে।সব মেয়েদেরই এই বয়সে এরকম হয়।প্রতি মাসে ৩-৭ দিন এরকম হবে। আমি কান্না করে দিলাম কেন আমার এগুলো হলো।আম্মু আমাকে বুঝাতে লাগলো যে এটা আনন্দের এবং গর্বের বিষয়।তারপর আম্মু আমাকে গোসল করে আসতে বললো এবং আব্বুকে দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পাঠালো।একটু পর আম্মু আমাকে কিভাবে পেন্টির সাথে পেড ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দিল।আমার খুব লজ্জা লাগলো।এরপর আব্বুর সাথে পরীক্ষা দিতে চলে গেলাম।

আমার অনেক মন খারাপ ছিল, বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার সেলোয়ার থেকে কামিজ এ দাগ লেগে যাবে,এই বুঝি পেড সরে সব কিছুতে রক্ত লেগে যাবে।পরীক্ষার সময় শেষ, আমি শেষের দিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না।সময়ের অভাবে।মন খারাপ হলো।২ টা পরীক্ষা আমার খারাপ হলো।অনেক কষ্ট হয়েছিল তখন।সে পরীক্ষার ফলাফল আমার একটু খারাপ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমি এই সময়টাকে জয় করেছি।

একদিন আমাদের একজন রিলেটিভির সমস্যা জানতে পারি।সে আমার থেকে ৫ বছরের বড় ছিল।তার মা আমার মায়ের কাছে তার মেয়ের সমস্যার কথা বললো। তার মেয়ে এখন দশম শ্রেণিতে পড়ে।বয়স ১৬/১৭ হবে।কিন্তু এখানেো তার ঋতুস্রাব শুরু হয়নি। এজন্য তাকে অনেক চিকিৎসা ও ডাক্তার দেখানো হয়েছে।কিন্তু কোনো ইতিবাচক ফলাফল হয়নি।আম্মু তখন আমাকে বললো যে ঋতুস্রাব না হলে কত সমস্যা হয় সে বিষয়ে। তখন থেকে ঋতুস্রাব হলে আমি আর মন খারাপ করিনা।ব্যথা বা কষ্ট যাই হোক না কেন এরমাঝেই আমি একটি পরিপূর্ণতার তৃপ্তি পাই।তখন থেকে আমি গর্ববোধ করি নিজেকে নিয়ে।আমি গর্ববোধ করি কারন আমার নিয়মিত ঋতুস্রাব হয়।আর নিয়মিত ঋতুস্রাব গর্বের বিষয় লজ্জার নয়।আমি বুঝতে পারি।পরবর্তী তে আমার ঐ আপুটির ঋতুস্রাব হলেও নিয়মিত হয়না।খুবই অনিয়মিত হয়।এখন সে সংসার জীবনে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তার এই সমস্যার জন্য তাকে নিরবে অনেক তিরস্কার পেতে হচ্ছে। আমার ঐ আপুর মত সমস্যা যেন কারো না হয় সে দোয়াকরি।পৃথিবীর সকল মেয়েরা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করুক এই প্রত্যাশা করি।এখনো প্রতি বার্ষিক পরীক্ষা এবং ১ডিসেম্বর আমাকে আমার এই দিনটির কথা মনে করিয়ে দেয়। ১ ডিসেম্বর ২০২০ আমার স্মরনীয় দিনটির মধ্যে একটি দিন।

লেখক : রিয়া মনি আক্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ।