আমি তখন সবে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। একাদশ শ্রেণিতে নতুন ক্লাস করছি,আমাদের দুইটা ক্লাস পরপর ক্লাসরুম চেইঞ্জ করতে হতো,প্রথম দুটা ক্লাস করে বের হওয়ার সময় হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম এক ফ্রেন্ডের সাদা এপ্রোন রক্তে ভরে গেছে, সে হোস্টেলেই থাকে, তাকে ডেকে বললাম প্যাড চেইঞ্জ করে আসতে।
কথা শুনে সে প্রথমে মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে গেল, এবং একটু পরে প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে এপ্রোন খুলে চেক করলো। এবং মুহূর্তেই তার দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো, কিছু বলার আগেই দৌঁড়ে হোস্টেলে চলে গেল সে।
না সেদিন আর সে কলেজে আসেনি, আসেনি পরের দুইদিনও। আমি পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম কারণ, সে বলল প্রচণ্ড লজ্জায়!
পিরিয়ডের সাথে বাঙালি নারীর যে শব্দটা চলে আসে তা হলো লজ্জা! লজ্জা নাকি নারীর ভূষণও। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লজ্জা পাওয়াটা কি আসলেই জরুরী? ছেলেদের মুসলমানী যতটা গর্ব আর সম্মানের, উৎসব করে লোক খাওয়ানোর, মেয়েদের পিরিয়ড যেন মুদ্রার ওপিঠ, লুকোছুপি করে চেপে যাওয়ার!
অন্য কেউ কি ভাবে জানিনা, আমার কাছে আমার পিরিয়ড আমার মাতৃত্বের প্রথম সূচনা, নারীত্বের অহংকার।
আমি চেষ্টা করি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে শখ আহ্লাদের কারণে নেইল পলিশ লাগিয়েছিলাম, পরিচিত একজন জিজ্ঞেস করেছিল কিরে নামাজ পড়িস না? অসুস্থ নাকি?
আমি হেসে জবাব দিয়েছিলাম, নারে আমি অসুস্থ না, সম্পূর্ণ সুস্থ। পিরিয়ড চলছে।
লজ্জার বিষয়ে লজ্জা পেলেও এক্ষেত্রে লজ্জা পেতে একটু হিসেবি আমি, হয়তো মেডিকেলে পড়ছি দেখেই জানি একটু বেশি, পিরিয়ডের সময় একটা মেয়ের হরমোনাল চেইঞ্জের কারণে শারীরিক-মানসিক কতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কারো আছে তল পেটে ব্যথা-ব্রণ ওঠা, জ্বর-মাথাব্যথা, কারো বা মুড সুইং। এসময় আপনজনদের একটু ভালোবাসা-যত্নই পারে এই দুঃসহ সময়গুলোকে আনন্দময় করে তুলতে। সবকিছু যদি চেপেই যাই লজ্জায়, নিজের উপর অবিচার করা হয়, না কি?
এ তো গেল নিজের কথা, পিরিয়ড নিয়ে আশ পাশের আলোচনায়ই ফিরে আসি। একবিংশ শতাব্দীতে আমরা যতই এগুই না কেন, মেয়েদের শরীরে চলমান একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকেও যতদিন আড়চোখে দেখা হবে আমার মনে হয়না আমরা নিজেদের এগিয়ে চলা বলতে পারবো। যেকোন ফার্মেসীতে একটা প্যাড কিনতে গেলে সেটা কাগজে মুড়িয়ে দেওয়া হয়, এমনকি কেউ কেউ নাকি পাউরুটির সাথে মিলিয়ে হাসাহাসিও করে, অনেক ঘরে নাকি এখনো পিরিয়ড একটা ট্যাবুর নাম, ভাবতেই অবাক লাগে!
ভারতের অক্ষয় কুমারের প্যাডম্যান নামক একটা ফিল্মে দেখেছিলাম, পিরিয়ড চলাকালীন মেয়েরা ঠিক কতটা স্বাস্থ্যঝু্ঁকিতে ফেলে নিজেদের, দিনের পর দিন স্যানিটারি প্যাডের বদলে ফাটা ত্যানা আর ন্যাকড়া ব্যবহার করে, এর ফলে কিন্তু যৌনাঙ্গে সংক্রমণ থেকে শুরু করে বন্ধ্যাত্বও হতে পারে। আমার নিজের দেশের অবস্থা যে তার চেয়ে বেশি ভালোনা তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা কিইবা বলব যেখানে একটা ছোট প্যাডের প্যাকেটের দাম ৫৫-৬০ টাকা। সেখানে তো প্যাডো বিলাসিতা। তার উপর আবার দুইদিন পর পর ফেসবুকে পোস্ট দেখি প্যাডের ভিতর মিলছে পোকা।
যত যাই হোক আমরা বেগম রোকেয়া আর প্রীতিলতার উত্তরসূরী, এত সহজে তো হার মানতে পারিনা এদেশ নিয়ে। আশা রাখি একদিন এদেশের প্রতিটা ঘরে ঘরে লুকানো পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙবে, পাঠ্যবই, সমাজে আর ভার্চুয়ালি কমবে ফিসফিসানি, রক্তের দাগের ভয়ে চুপশে থাকা মেয়েরাও নিজের শরীরের জন্য, স্বাস্থ্যের জন্য আওয়াজ তুলবে, উঠে দাঁড়াবে! আমার চোখে সেদিনই উঠে দাঁড়াবে বাংলাদেশ!
লেখক : সাবরিনা মনসুর, শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ