মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে বলতে গেলে আমি বলবো যে, এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যে, যেখানে বাসার পুরুষ সদস্যদের সাথে যেমন: বাবা, আমি আমার বাবাকে নির্দ্বিধায় স্যানিটারি ন্যাপকিন ফুরিয়ে গেলে কিনে আনার কথা বলতে পারি। বাজারের লিস্টে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সাথে স্যানিটারি ন্যাপকিন লিখতে আমার আর এখন সঙ্কোচবোধ হয় না, মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে ভরসার জায়গা হচ্ছে তার বাবা, আর সেই ভরসার স্থলকে যদি আমি নিঃসঙ্কোচে আমার জীবনের, প্রতি মাসের কয়েকটা দিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কথা বলতে পারি তাহলে আর কি চাই!! নিজে প্যাড কিনতে গেলে ফার্মেসির বাইরে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ ভাবতে হয় না যে, দোকানে যেয়ে কি বলবো? দোকানদার ও তার সহকারীরা আমার প্যাড কিনতে আসায় হাসাহাসি করবে কি না, যদি করেও বা তার থোড়াই কেয়ার করি আমি!! মাসিকের সময়টাতে প্রয়োজন পড়লে একজন ছেলেবন্ধুকে বলতে বাঁধে না যে, কেন আমি অসুস্থ। অধিকাংশ মেয়েরা মাসিক নিয়ে ছেলেদের নোংরা বিদ্রূপের শিকার হয়। সেটা হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা সরাসরি কিন্তু আমি এ ধরণের কোনো বিদ্রূপের সম্মুখীন হইনি। সবশেষে বলতে পারি, এই যে, আমি এই ব্লগ কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করছি এটাও তো মাসিক নিয়ে আমার এ পর্যন্ত যাত্রার একটি ইতিবাচক দিক। এ পর্যন্ত আমি যা যা বললাম তাতে মনে হতে পারে যে, মাসিক নিয়ে আমার কোনো খারাপ অভিজ্ঞতাই হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা পর্যন্ত পৌঁছানোর যাত্রাটা সহজ ছিল না। আজ সেই যাত্রার গল্পই বলা যাক।
। আমার মাসিক শুরু হয়, ৮ম শ্রেণিতে থাকাকালীন। মেয়েদের জীবনে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের ব্যাপারে আমি পরিবার থেকে কোনো সঠিক ধারণা পাইনি বললেই চলে। পরিবারের মহিলা সদস্য বা আত্মীয়স্বজন যেমন, আমার মা এবং নানীর কাছ থেকে যেটুকু শুনেছিলাম তা কুসংস্কারে ভরপুর ছিল এবং সেটা জেনেছি আমার মাসিক হওয়ার পর। বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হওয়ার আগে পরিবারের সাথে একসাথে বসে যখন টিভি দেখতাম তখন স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখে মনে প্রশ্ন জাগত যে, এগুলো কী!! কি করে এগুলো দিয়ে? কয়েকবার প্রশ্নও করেছিলাম। আমার মা শুধু উত্তর দিত যে, “এগুলো বড় হলে মেয়েদের লাগে”। ব্যস, এতটুকুই তাও অনেক সঙ্কোচ নিয়ে। উত্তর শুনে মনে হত খুবই গোপনীয় কিছু। পরিবার থেকে মাসিকের ব্যাপারে সঠিক ধারণা না পেলেও এক্ষেত্রে আমি ধন্যবাদ দেবো, আমার বান্ধবীদের, ওদের গোপন আলোচনা থেকেই এ ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম। আমার সকল বান্ধবীদের ততদিনে মাসিক শুরু হয়ে গেছে কেবল আমার ছাড়া। এটা নিয়ে একটু চিন্তায়ও ছিলাম। তবে আমার সকল চিন্তা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দূর করেছিল স্কুলে প্রচার প্রচারণার কাজে আসা একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কোম্পানির বিভিন্ন কার্যক্রম। ধারণা তো পেলাম কিন্তু যখন আমার মাসিক শুরু হল, আমার মা আমাকে কাপড় ব্যবহার করতে বলল। ঐ কয়েকদিন মাছ খেতে দিল না কারণ এতে নাকি রক্তস্রাবে দুর্গন্ধ হয়। আরো বলেছিল যেন রান্নাঘরে না যাই। এছাড়া ঐ সময় সন্ধ্যার দিকে চুল খুলে বাইরে ঘোরাফেরা করতেও নিষেধ করে দিল। এতে নাকি খারাপ বাতাস লাগে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার কি করে করতে হয় তা স্কুলে ঐ কোম্পানির কার্যক্রমের ফলে আমি জানতাম কিন্তু ঘরে প্যাড না থাকায় অগত্যা মায়ের কথামত কাপড় ব্যবহার শুরু করলাম এবং জ্ঞানের অপরিপক্কতার হেতু মায়ের বলা বিভিন্ন নির্দেশনাও মেনে চলেছিলাম কয়েক মাস। ভেবেছিলাম সে তো অভিজ্ঞ, তার কথা মেনে চলাই ঠিক হবে। এরপর শুরু হলো আমার জেএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় আমার মাসিক শুরু হল। প্রথম ২ দিন তো ফ্লো বেশি হয়, আর আমার একটা পরীক্ষাও পড়ল মাসিকের ২য় দিন। ফ্লো বেশি হওয়ার কারণে কাপড় ভিজে সেটা স্কুল ইউনিফর্মের সাদা সালোয়ারে লাগল, কামিজে লাগল এবং অবশেষে বেঞ্চেও লাগল। লেখায় মশগুল আমাকে যখন পেছন থেকে আমার এক সহপাঠী ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত করল, তখন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। সবার সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়। পাশে বসা এক সহপাঠীর কাছ থেকে ওর পানির বোতলটা চেয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে কামিজের জায়গাটা ধুয়ে নিলাম। তখন আমার একটাই চিন্তা ছিল কেউ যেন আমার ব্যাপারটা জানতে না পারে বা পানি দিয়ে কামিজ ধোয়ার দৃশ্যটা যেন না দেখে। বেঞ্চের কোণার দিকে আমার সিট পড়ায় ব্যাপারটা কারো চোখে পড়ল না। মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্য ভালো যে, আজ ডিউটিতে কোনো পুরুষ শিক্ষক আসেননি। পরীক্ষা শেষে বেঞ্চটা পরিষ্কার করলাম এবং কয়েকজন বান্ধবীর কথায় স্কার্ফ খুলে মাজায় বাঁধলাম এবং যত দ্রুত সম্ভব কোনোমতে বাসায় ফিরলাম। এই ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েক বছর। কলেজে পা রাখলাম এবং আমি ততদিনে প্যাড ব্যবহার করতে শুরু করলাম। তবে শুরু হল আরেক সমস্যা। ফার্মেসিতে যেয়ে প্যাড কিনতে খুবই সঙ্কোচ বোধ করতাম এবং এ কারণে আমার এক বান্ধবী আমাকে প্যাড কিনে এনে দিত। এভাবে তো চলতে পারে না। ভাবলাম, আমাকেই ফার্মেসিতে যেয়ে প্যাড কিনে আনার কাজ করতে হবে। তারপর সাহস করে একদিন গেলাম প্যাড কিনতে। এভাবেই সংশয় কাটিয়ে আমার যাত্রা শুরু।
মাসিকের সময় মাছ না খাওয়া, চুল খুলে সন্ধ্যার সময় ঘুরে বেড়ানো সহ আরো যা যা কুসংস্কার প্রচলিত আছে, সেটা আর মানলাম না। তবে মাসিকের সময় কখনো কখনো অসাবধানতাবশত যখন বিছানার চাদরে একটু রক্ত লেগে যেত, সেটা নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি আমাকে। মাঝেমাঝে প্রচন্ড কান্না পেত। কাঁদতামও, কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে শক্ত করেছি। মাসিকের দিনগুলোতে মেয়েরা অশুচি, সমাজের আনাচে-কানাচে এখনও এই মনোভাব কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে। সেটা আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি।
তবে আমি আমার মা কিংবা নানীকে এক্ষেত্রে পুরোপুরি দোষারোপ করবো না। তারা যেমনটা শিখে এসেছে তাদের মা, নানী, দাদীর কাছ থেকে তেমনটাই আমাকেও শিখিয়েছে। তাদের সময় প্যাড ছিল না তাই স্বাভাবিকভাবে প্যাডের ব্যবহারবিধি তারা জানবে না। মাসিক সম্পর্কে প্রকৃত শিক্ষার অভাবই তাদের এরকম মনোভাবের কারণ। এছাড়া আরেকটি বিষয় আমি বলতে চাই যে, অধিকাংশ মেয়েরাই বিষয়টি লুকিয়ে রাখার পরামর্শ দেয়, কেন? যেন খুবই লজ্জাজনক বিষয়। মাসিক হলে যে, মেয়েদের সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে হবে আমি সেটা বলছি না। অন্তত, দরকার পড়লে যেন সেটা লুকিয়ে রাখা না হয়। ছেলেদের তরফ থেকে বিরূপ মনোভাবের শিকার অনেক মেয়েই আছে তবে এক্ষেত্রে আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি যে, আমি এমন কোনো আচরণের শিকার হইনি বরং একবার তলপেটে ব্যথায় কাতর এক ছেলেবন্ধুকে আমার অসহ্য ব্যথার কথা বলায় সে আমাকে ডার্ক চকলেট খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময় আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে অসহ্য ব্যথা প্রশমনের অনেক পরামর্শ পেয়েছি। আমার এ যাত্রায় যাদের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই যে, আমাদের ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে একটা বিষয় ছিল, গার্হস্থ্য অর্থনীতি। ঐ বইয়ে একটি অধ্যায় ছিল মাসিক নিয়ে কিন্তু উক্ত বিষয়ের শিক্ষিকা আমাদের ঐ বিষয়টি পড়াতে দ্বিধাবোধ করায় বলেছিলেন, “তোমরা নিজে নিজে পড়ে নিও।” এক্ষেত্রে বলবো যে, মাসিককে একটি প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক ঘটনা বলেই গণ্য করা হোক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা যাতে এ বিষয়টি শ্রেণিতে যত্নসহকারে পড়ান এবং সকল সংশয় দূর করেন এটা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। পাশাপাশি ঐ দিনগুলোতে যেন মেয়েদের দিকে পরিবারের সদস্যরা একটু যত্ন নেয়, দুটো ইতিবাচক কথা বলে এটাও খুবই দরকার। আর যেকথাটি সবার শেষে বলতে চাই সেটি হল, মেয়েদের শক্ত হতে হবে। কুসংস্কারের বশবর্তী হওয়া যাবে না। কোনো সমস্যা হলে যাদেরকে নির্ভরযোগ্য মনে হয় তাদের সাথে কথা বলতে হবে এবং দরকার পড়লে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এখন অনেককিছু পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, ট্যাবু ভাঙছে কিন্তু পরিবর্তনের সূচনা মেয়েদের নিজেদেরই করতে হবে। “মুক্ত করো ভয়, আপন মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।”
লেখক: হালিমা আক্তার তন্বী, শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়