মা,আমার তলপেটে অসহ্য ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মা,কোনদিকে শুয়েই কিছু হচ্ছেনা।মা,গরম পানিতেও ব্যথা উপশম হচ্ছেনা।মা,আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখের মেয়েদের হৃদয়বিদারক কিছু বুলি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করি,পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম শব্দ হলো চার অক্ষরের একটি শব্দ “ঋতুস্রাব”।শব্দটি শুনলে ধারণা করা হয় কোনকিছু প্রবল বেগে নিঃসৃত হওয়া।বাস্তবের সাথে শব্দটির এ যেন এক অভূতপূর্ব মিল।ভাবতেই অবাক লাগে চার অক্ষরের একটি মাত্র শব্দের মধ্যে কী অসহ্য যন্ত্রণা,বেদনা লুকিয়ে আছে।
সময়টা ২০১২ সাল।আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি।ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল,নানা প্রাকৃতিক পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে আমার কোন পূর্বধারণা ছিলনা।মূলত ষষ্ঠ শ্রেণীর “শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খেলাধুলা “বইটির মাধ্যমেই আমার এগুলো সম্পর্কে প্রথম ধারণা হয়।তবে ঋতুস্রাব শব্দটির সাথে আমি আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম।বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে ঋতুস্রাবের বিষয়টি মেয়েদের গল্পগুজবের একটি প্রধান বিষয়বস্তু।বান্ধবীরা এক সাথে হলেই একে অন্যকে বলে,এই আজ তোর কয়দিন?এই তোর ঋতুস্রাব হয়েছে?বলিস কী!এখনো তোর ঋতুস্রাব হয়নি।মূলত এই আলোচনা থেকেই শব্দটির সঙ্গে আমার পরিচিতি।যাই হোক,দিনটি ছিল ২৫ শে মার্চ।২৬ শে মার্চের খেলাধুলা প্রতিযোগিতা উপলক্ষে স্কুলে রীতিমতো রিহার্সেল চলছে।আমি তো আনন্দে আত্নহারা।প্রথমত,পড়ার ফাঁকি আর দ্বিতীয়ত খেলাধুলা।খেলাধুলার মধ্যে যে প্রতিযোগিতার প্রতি আমি সবচেয়ে বেশি দুর্বল তা হলো দৌড় প্রতিযোগিতা।দৌড় প্রতিযোগিতা আমাকে চৌম্বকের মতো আকর্ষণ করে।প্লে-ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া দৌড় প্রতিযোগিতায় আমার অবস্থান ছিল প্রথম।স্কুলে সবাই আমাকে জুনিয়র দ্রুততম মানবী বলে ডাকত।আমিও অনেক উৎসাহ পেতাম।যাই হোক,বিকেলে কোচিংয়ের দু ক্লাস পরেই শুরু হত রিহার্সেল।২ ঘন্টার রিহার্সেল শেষে আবার একটি ক্লাস হয়েই স্কুল ছুটি।প্রতিদিনের মতো আজও রিহার্সেল শেষ করে সবাই ক্লাসে চলে এসেছি।ঘন্টা পড়ে গেলে ম্যাডাম ক্লাসে চলে আসলেন।ম্যাডামকে সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্য যখন উঠে দাঁড়াচ্ছিলাম তখন আমার পায়জামার উপরের দিকে কেমন এক আঠালো অনুভূত হল।অস্বস্তি লাগতেও শুরু করেছে।এরকম কেন লাগছে?
ভাবলাম,খেলাধুলা করেছি;ঘামের কারণে এরকম মনে হচ্ছে।আমি জামা টেনেটুনে ঠিক করে নিলাম।যদিও মা আমাকে ঋতুস্রাবের বিষয়টি নিয়ে পূর্বেই সতর্ক করেছিলেন কিন্তু খেলাধুলা আমার মস্তিস্ককে এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছিল যে বিষয়টি আমার চিন্তাধারার বাইরে ছিল।ম্যাডাম ধারাবাহিকভাবে পড়া নিতে শুরু করেছেন।যখন আমার ক্রম আসল আমি পড়া দিতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো আমার পায়জামার উপরের অনেকটুকু অংশ ভিজে গেছে।ভীষণ স্যাঁতসেঁতে অনুভূত হল।কিছু না বুঝে আমি ইতস্তত করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ একটি ছেলেকে বলতে শুনলাম,দেখ দেখ জেরিনের পিছনে লাল রক্তের দাগ।আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।আমার সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছিল।আমি আর সামনে এগিয়ে যেতে পারছিলাম না।ম্যাডাম বারবার আমাকে ডাকতে লাগলেন।সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার শক্তি আমার ছিল না।আমি ঐ জায়গায়-ই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।আমি যাচ্ছিনা দেখে ম্যাডাম রাগত ভঙ্গিতে নিজেই আসলেন আমার কাছে।ম্যাডাম কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আমি অঝোর ধারায় কান্না শুরু করে দিলাম।ম্যাডাম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,এই মেয়ে,তুমি কাঁদছ কেন?আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,ম্যাডাম,আপনি একটু আমার সাথে কমনরুমে চলুন।কী আশ্চর্য!ম্যাডাম আর একটি কথাও না বলে সরাসরি আমার সাথে কমনরুমে চলে আসলেন।এরপর আমি ম্যাডামকে আমার জামার পিছনের অংশ দেখালাম।ম্যাডাম আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে বললেন,এই ব্যাপার!পাগলী মেয়ে,এর জন্য কাঁদতে হয়?মায়ের ফোন নং টা বলত?আমি বললাম,০১৫৬…….।তিনি মাকে ফোন করে বিস্তারিত বললেন।আমাকে আদরের সঙ্গে বোঝাতে লাগলেন,পিরিয়ড অতি স্বাভাবিক ব্যাপার,বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে প্রতিটি মেয়েরই পিরিয়ড হয় ইত্যাদিসহ আরো অনেক কিছু।কথা বলতে বলতে মা এসে উপস্থিত।মা আমার জন্য একটি অতিরিক্ত জামা নিয়ে এসেছেন।জামা বদলে আমি মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরলাম।এরপরই শুরু হলো চার অক্ষরের ব্যাপক নিষ্ঠুরতা।অসহ্য ব্যথায় বিছানায় গড়াগড়ি আর অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ।প্রথম দু’দিন এক নিমেষের জন্যও চোখের পাতা বন্ধ করতে পারিনি।প্রথমত,পিরিয়ডের যন্ত্রনা আর দ্বিতীয়ত, দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতা।রাগে,দুঃখে,যন্ত্রণায় শুধু বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছি।তিনদিনের দিন যখন নিজেকে আয়নায় দেখলাম তখন নিজেই চমকে উঠলাম।মনে মনে বললাম,হায়! প্রাকৃতিক পরিবর্তন।
আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।মনের জোর দিয়ে পিরিয়ডের যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করি।চেষ্টা করি পিরিয়ড যেন আমার কোন কাজের বাঁধার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।সেদিনের দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যর্থতা আজ আর আমাকে ব্যথিত করেনা।স্কুল,কলেজ পেরিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন।কিন্তু সেদিনের যে বিষয়টি এখনও আমাকে পীড়া দেয় তা হলো ছেলেদের কানাকানি।ঘটনাটি আমার স্মৃতিতে একটি কালো দাগ কেটে আছে।মাঝে মাঝে ভাবি ছেলেদের মন-মানসিকতা কেন এত নিচু?ওরা যদি পিরিয়ডের যন্ত্রণা বুঝত তাহলও কি ওরা সেদিন ওমন করত?।তবে ইদানীংকালে আমার এই ধারণার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।একদিনের একটি ঘটনার কথা আপনাদের বলি।আমি ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।ট্রাফিকের কারণে বাস এক মোড়ের মাথায় থেমে আছে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই একটি মেয়ের দিকে চোখ পড়ল।দেখি,মেয়েটি প্রবল অস্বস্তি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।ভাল করে খেয়াল করতেই দেখলাম মেয়েটির স্কুল ড্রেসের সাদা ফ্রকের পিছনে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে।মেয়েটি ব্যাগ দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যাগের বেল্ট ছোট হওয়ার কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা।এরই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে একটি ছেলে এসে মেয়েটির সামনে দাঁড়াল।নিজের ইউনিফর্মের শার্টটি খুলে মেয়েটির হাতে দিল।মেয়েটি শার্ট কোমরে বেঁধে নিল।দৃশ্যটি দেখে অজান্তেই আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।ছেলেটি চলে যেতে যেতে যতদূর পর্যন্ত দেখা গেল আমি ছেলেটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।যে মা ছেলেটিকে এমন আদর্শে দীক্ষিত করেছেন সেই মায়ের প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা।
লেখক : সুমানা হক তুলি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়