সুরক্ষিত নারী, সুরক্ষিত স্বদেশ

“পিরিয়ড” চারটি বর্ণের একটি ছোট শব্দ বাংলায়,যার সাথে জড়িয়ে আছে প্রতিটি মেয়ের অসহনীয়,অবর্ণনীয়,দুঃসহ কষ্টের গল্প,শরীরের ভিতরে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ভাঙ্গাগড়ার খেলা।

মেডিকেল সায়েন্সের ছাত্রী হওয়ায় খুব কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়ছে এই পিরিয়ড,ম্যান্সট্রুয়াল সাইকেলের জটিল জটিল কিন্তু চমকজাগনীয় মেকানিজম সম্পর্কে।কি অবলীলায় প্রতিটি মেয়ের দেহের ভিতর ঘটে চলে আরেকটি প্রাণের বিকশিত হওয়ার পরিবেশ তৈরির প্রক্রিয়া।প্রতিমুহূর্তে ইস্ট্রোজেন,প্রজেস্টোরন আপনমনে করে চলছে তার কাজ,আর তা আমাদের কাছে ধরা দিচ্ছে তীব্র পেট ব্যাথা,মাথা ব্যাথা, মানসিক অবসাদ সহ আরও কত শত রুপে। এসব হরমোনের উঠানামা,জরায়ুর ভাঙ্গাগড়ার মাধ্যমে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলে নারী দেহে।

প্রতিমাসে প্রায় ৮০মিলি নিগর্ত হওয়া রক্ত,জরায়ুর ভগ্নাংশ, ডিম্বানু যেন প্রতিনিধিত করে চলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠার পথে প্রতিটি মেয়ের সংগ্রাম,তীব্র ব্যাথা,ধৈর্য, শ্রম,তিতিক্ষা, সহপাঠীর উপহাসের গল্প কিংবা প্যাড কিনতে যাওয়া ফার্মেসির দোকানদারের ক্রুর হাসির।

এসব জানতে জানতে একজন নারী হিসেবে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট মনে হওয়ার পরক্ষণেই মনে জমা হয় ভয়,অসহায়ত্ব। এই ভয়, অসহায়ত্ব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নিম্ন আয়ের অনেক দেশের নারীদের।এই ভয়,অসহায়ত্বের জন্মের পিছনের কারণ এখনও এসব দেশে পিরিয়ড একটি সামাজিক ট্যাবু,এসব দেশে পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা নিষেধ,নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা যেন কোন অলীক কল্পনা।এই কারণে প্রতিমাসের সেই ভয়াবহ যন্ত্রণার ৬-৭দিনেও পৃথিবীর প্রায় ৫০০ মিলিয়ন নারী পিরিয়ড সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সামগ্রী ও পরামর্শ পায় না।বাংলাদেশের ৪০শতাংশ মেয়ে পিরিয়ডকালীন সময়ে গড়ে ৩দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে,গ্রামের অধিকাংশ কিশোরীর পিরিয়ডের সময় কাটে পুরাতন ছেড়া কাপড় ব্যবহার করে।এসব দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে গণ্য করা হয় বিলাস দ্রব্য হিসেবে,আরোপ করা হয় কর,ফলে এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য হয়ে উঠে নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে।প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণে প্রতিবছর জরায়ুমুখ ক্যান্সারসহ নানা প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত রোগে,স্কুলে আলাদা টয়লেট না থাকা,অপুষ্টির অভাব, নানা কুসংস্কারসহ বিভিন্ন কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে হাজারো কিশোরী।বেড়ে উঠার সময়ই মুখ থুবড়ে পড়ছে অনেক কিশোরীর স্বপ্ন।

 তবু স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে না।কারণ,
 "স্বপ্ন কাঁদায়,স্বপ্ন হাসায়,স্বপ্ন দেখায় আলো
 স্বপ্ন দিয়েই মানুষ দেখে তোমার সকল ভালো।" 

সপ্ন দেখি এক দিন বাংলাদেশের সব কিশোরী পাবে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত সব তথ্য,পরামর্শ। প্রতিটি স্কুলে হবে এই সম্পর্কিত কর্মশালা,ক্লাস,থাকবে স্যানিটারি ন্যাপকিন,মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা।মাসের ওই বিশেষ দিনগুলোতে মানসিক সার্পোট দেওয়ার জন্য থাকবে আলাদা হটলাইন বা অন্যকোন ব্যবস্থা।দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার সেসব কিশোরীদের পরিবারকে দেওয়া হবে ওই বিশেষ সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পরামর্শ, নিশ্চিত করা হবে তাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার।সুরক্ষিত হবে বাংলাদেশের সমস্ত নারীও কিশোরীর প্রজনন ও মানসিক স্বাস্থ্য।পিরিয়ডকালীন সময়ে স্কুল মিস করার কারণে আর কোন কিশোরীর স্বপ্নপূরনের পথে সৃষ্ট হবে না কোন বাঁধা।

আজকের এই কিশোরী,নারীরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ, তাদের সুরক্ষিত করা মানে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করা।তারাই আগামী,তাদের হাত ধরে আসবে নতুন ভোরের সূর্য।কবির ভাষায়,

 "হে নিত্যানন্দ যৌব,এ তোমার সময়,অমূল্য
 তুমি পৃথিবীরই পুষ্প,অস্ফুট অকুন্ঠ্যে দোল্য 
 তুমিই শক্তি,মানবী আধাঁরের সমুজ্জ্বল রবি
 সতুল্য।" 

লেখক : মেহজাবীন বিনতে তৌহিদ, শিক্ষাথী