পিরিয়ড নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা

সালটা ২০১৫। রাবি তে ইভিনিং প্রোগ্রামে মাস্টার্স করছি। ফার্স্ট সেমিস্টারের প্রেজেন্টেশন ছিল সেদিন। ম্যাম গ্রুপ করে দিয়েছিলেন। আমার গ্রুপে আমার অনার্সের কোন বন্ধু ছিল না, যারা ছিল সকলের সাথে মাস্টার্স করতে এসেই পরিচয় তাই অতটা ফ্রিও হতে পারিনি।

আমাদের অনার্সের মোট ৬/৭ জন ফ্রেন্ড আমরা রাবি তে ভর্তি হই কিন্তু সেই প্রেজেন্টেশন টা সবাই আলাদা আলাদা গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছিলাম। ১ দিনে ২ টা গ্রুপের প্রেজেন্টেশন হতো।

আমার গ্রুপ আর আমার ফ্রেন্ড সুপ্তর(অনার্স ফ্রেন্ড) গ্রুপ একই দিনে ছিল।

সেদিন বিকেলে প্রেজেন্টেশন ছিল কিন্তু আমি সকালেই সুপ্তর বাসায় চলে গেছিলাম

রেডি হয়েই। যেহেতু আইন বিভাগে পড়াশোনা তাই প্রেজেন্টেশনে সাদা ড্রেসই পরতাম, সেদিনও তাই পরেছিলাম।

সকাল থেকে প্রেজেন্টেশন টপিক নিয়ে দুইজনে আলোচনা করে দুপুরে লাঞ্চের পর বের হবার আগে আমি ওয়াশরুমে যাই।

গিয়েই তো আমার অবস্থা খারাপ, ডেটের ৭/৮ দিন আগেই পিরিয়ড হয়ে গেছে, কোন প্রিপারেশন নেই আমার। সাদা সালোয়ার কামিজ পরা অবস্থায় কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। কোন রকমে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমি আন্টিকে খুঁজছি, সুপ্ত বলল আম্মু তো নানুর বাসায় গেল। আব্বু আছে বাসায়। আমার তো মাথায় হাত তখন কি করবো! আমরা সব বন্ধুরা অনেক ফ্রি হলেও নিজের পিরিয়ডের বিষয় নিয়ে তো ফ্রি নই।

এরকম ডেটের আগে কখনো হয়না,বরং পরেই হয়, আর আমি ক্যাম্পাসে যাবার জন্য ১০০/- নিয়ে বের হয়েছি ছোট সাইড ব্যাগে বড় ব্যাগ নিইনি সেদিন। এখন স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনলে তো ফেরার টাকা থাকবে না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে আমি যে লেডিস মেসে থাকি সেখানে ব্যাক করলে আর ভার্সিটি পৌঁছাতে পারবো না, দেরি করলে ম্যাম সবার সামনে বকা দেবেন কারণ ২ সপ্তাহ আগেই ডেট দিয়েছেন যেন আমরা সময় মতো উপস্থিত হই। সুপ্তও তাড়া দিচ্ছে। ওকে বললাম তোর কাছে ১০০/- হবে আমাকে দে জরুরি দরকার আমার। সুপ্ত খুব স্বাভাবিক গলায় বলল যে নে। সুপ্ত অটো নিতে চাইল আমি বললাম রিকশা নে, ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে নামবো। আচ্ছা রিকশায় নেয়া হলো।

আমি আবার বললাম যে সামনে যে ফার্মেসী পাবি দাঁড়াতে বলবি।

আর ঝটপট একটা কাগজে স্যানিটারি ন্যাপকিন এর নাম লিখে দিলাম।

ফার্মেসীর সামনে রিকশা থামতেই আমি বুঝতে পারলাম আমার পক্ষে নেমে যাওয়া খুব মুশকিল হবে কাগজ টা সুপ্তর হাতে দিয়ে বললাম এটা এনে দে।

ও চুপচাপ সেটা নিয়ে এসে যেহেতু ওর ব্যাগ ছিল সেই ব্যাগেই সেটা রাখলো। আমাকে কোন প্রশ্ন না করেই স্বাভাবিক প্রেজেন্টেশন নিয়ে কথা বলতে বলতেই আমরা ভার্সিটি পৌঁছালাম।

রিকশা থেকে নেমেই ও খুব দ্রুত ডিপার্টমেন্টের দিকে হেঁটে গেল আর আমাকে বলল আসতে আসতে আয়।

আমি লম্বা কোরিডোর শেষ করে গিয়ে দেখি ও পিয়ন কে বলে আইন বিভাগের কনফারেন্স রুম টা খুলিয়েছে, যেন আমি সেটার এটাচড বাথরুম ইউজ করতে পারি।

আমাকে অবাক হবার সময়টাও ও দেয়নি।

বলল তারাতাড়ি যা, হাতে ১৫ মিনিট সময় আছে এর ভিতর ক্লাসে যেতে না পারলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম। আর গেট টা লাগিয়ে দে অন্য কোন টিচার দেখলে প্রশ্ন করবে, পিয়নকেও ঝাড়বে।

আমিই দেরি না করে দ্রুত ভিতরে গেলাম।

১০ মিনিটের ভিতর ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখি সুপ্ত দাঁড়িয়ে আছে।

আমার হাত থেকে কাগজে মুড়ানো স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট টা দ্রুত ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, চল চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।

প্রেজেন্টেশন শেষ করে শুনলাম সব ছেলেরা নাকি আজ বারবিকিউ পার্টি করবে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমি দ্রুত বের হচ্ছি ক্লাস থেকে, সুপ্ত বলল চল।

আমার আরেক দফা অবাক হবার পালা

আমি বললাম তুই পার্টিতে থাকবি না।

ও বলল তোর জিনিস আছে না আর তাছাড়া তোকে এই অবস্থায় একা ছাড়তে পারিনা। এবার আমি আর চুপ থাকলাম না ওকে বললাম তুই কি ক্লাসের অন্যদের বলে দিয়েছিস? সুপ্ত হেসে বলল পাগোল নাকি এটা আবার বলার কি হলো, আর সবার মন মানসিকতা কি এক? ছেলেরা জানলে এটা নিয়ে হাসাহাসি করতো আর মেয়েরা জানলে তোকে কথা শোনাত যে কেন তুই আমাকে বললি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে পিরিয়ড নিয়ে আমাদের ধারণা এখনো পাল্টাইনি বুঝলি।

তবে আমি সিওর আমি তো কাউকেই বলবোনা তবে তুইই সাদিয়া, নাফিসা এদের বলবি, কি বলবি তো তাই না?

আমিও এবার হাসতে হাসতে বললাম তুই এতো বড় একটা উপকার করলি ওদের তো বলতেই হবে। ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা।

আমাকে মেসে নামিয়ে দেয়ার পর আমি যখন ডাকলাম সুপ্ত…..

সাথেই সাথেই সুপ্ত বলে উঠলো-

থাক, আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা ধন্যবাদ খরচ করতে হবে না। তোর সাথে আমার তো এতো ফরমাল সম্পর্ক না।

*********************

আমি অনেক জায়গায় অনেক ঘটনা পড়েছি পিরিয়ড নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে অনেক মেয়েই পরে।

কিন্তু পাশের বন্ধু বা আত্মীয় যদি একটু সহোযোগিতা করে তবে আমরা এই রকম পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারি।একটা সময় পর্যন্ত প্রচুর লজ্জা লাগলেও এখন পিরিয়ডের সময় কোন কঠিন কাজের বা ধর্মীয় কাজের দায়িত্ব পেলে আমি আমার সহকর্মী বা বন্ধুদের বলি যে আমার কি হয়েছে। সে পুরুষ হোক বা মহিলা। ঠিক সেরকম ভাবেই আমিও যদি জানতে পারি আমি আমার বন্ধু বা সহকর্মী কে এই রকম সিচুয়েশনে সাহায্য করি।

পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে যে যন্ত্রণা হয় সেটা শুধু মেয়েরাই বুঝি। তাই লজ্জা, সংকোচ থেকে বেড়িয়ে এসে নিজের জন্য হলেও সঠিক কথাটা বলে ঘরে বাইরে সঠিক যত্নটুকু আমরা নিজেই আদায় করে নিতে পারি। আমার ওয়াশরুম যাওয়া দরকার এটা যদি আমরা নির্দিধায় বলতে পারি তবে আমার পিরিয়ড হয়েছে আমি এই কাজ টা এখন করতে পারবো না এটা বলতে কেন লজ্জা লাগবে?

দুটোই তো প্রাকৃতিক নিয়মে হয়, তাই না!

লেখক : সুমাইয়া চৌধুরী ওরিন, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়